উত্তরণ : সায়ন্তনী দাস ধর



ঝটপট তৈরি হচ্ছিল সুরমা। আজ বড্ড দেরী হয়ে গেছে। আজও বোধহয় স্কুলে লেট হয়ে যাবে, বড়দির গম্ভীর মুখের সামনাসামনি হতে হবে। কিন্তু কিই বা করে সুরমা? সেই ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না, কাচাকুচি -সংসারের হাজার একটা কাজ সেরে মেয়ে সুমীকে ঘুম থেকে তুলে তাকে সঠিক সময়ে তৈরি করে স্কুলে পাঠায় সে। ইতিমধ্যে আয়ামাসি এসে যায়। তাকে সারা দিনের কাজ বুঝিয়ে নিজে কোন রকমে দুটি নাকে মুখে গুঁজে স্কুলে ছোটে । সময় যে কি করে সুরমার আগে দৌড়ে পালায়! সুরমা বিকেলে বাড়ি ফিরলে আয়ামাসির ছুটি। তারপর মেয়ের সঙ্গে গল্প, পড়াশোনা, রাতের রান্না- এসব করতে করতেই কখন যেন দিন ফুরিয়ে যায়। 


          এভাবেই দশ বছর চলছে। সুবীরের সঙ্গে ডিভোর্সটা হয়ে যাবার পর সুবীরের কাছে একমাত্র মেয়ে ছাড়া সুরমার আর কোন দাবী ছিল না। সুবীরও বেঁচে গেছে। তার যে তখন নতুন সংসার পাতার তাড়া। সেখানে সুমী বাড়তি। মা মেয়ের সংসার সুখে দুখে হেসে খেলে মন্দ চলছে না। তবে ঐ, মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত বোধ করে সুরমা। মাঝে মাঝে মনে হয় পাশে যদি কেউ থাকত! পরক্ষণেই এই অন্যায় ভাবনার জন্য নিজেকে দশবার দোষ দিতে থাকে সুরমা। 


             না, ঠিক তেমন করে নয়,তবে বন্ধু একজন আছে সুরমার। বিমান- মাঝে মাঝে সুরমার সংসারে আসে খোলা হাওয়ার মত। সুমীও খুব পছন্দ করে তার বিমানকাকুকে। যত আব্দার তার বিমানকাকুর কাছে। বিমানও বড্ড ভালোবাসে সুমীকে। তারও যে একটা সংসার ছিল, একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল। মেয়েটা সুমীরই বয়সী। ভাগ্যে সয়নি তার সুখ। দুই একাকী নারী পুরুষ খেলাঘরে পুতুল সাজিয়ে খেলা করে। 


           কিন্তু, আমাদের সমাজসংস্কারকরা! তারা সুরমার বাড়িতে বিমানের আসা যাওয়া বাঁকা চোখে দেখতে লাগল। ঠারেঠোরে কথাও শোনাতে শুরু করল। অপমানে কুঁকড়ে যায় সুরমা। একদিন ডেকে পাঠায় বিমানকে। তাকে নিজের অসহায়তা অপমানের কথা বলে। বলে, বিমান যেন আর তাদের বাড়িতে না আসে। এমন সময় পাশের ঘর থেকে সুমী এসে দাঁড়ায় তাদের মাঝে। দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে, " মা, এ তোমার কেমন সিদ্ধান্ত? আমি অসুস্থ হলে বিমানকাকু ছাড়া আর কে ডাক্তারবাবু, ওষুধপত্র- এসবের ব্যবস্থা করে? আমার মন খারাপ হলে এই বিমানকাকুই তো কতভাবে চেষ্টা করে আমার মন ভালো করার। আগে আমার বন্ধুদের যখন তাদের বাবার সঙ্গে ঘুরতে যেতে দেখতাম , আনন্দ করতে দেখতাম, আমার খুব মন খারাপ হত। এখন হয় না। কেন, জান মা? বিমানকাকুর মধ্যে আমি যেন আমার বাবার ছায়া দেখতে পাই। সঠিক পরামর্শ আর ভালবাসা আমি অনেক পেয়েছি কাকুর কাছে। কাকুর সঙ্গে বেড়ানো, সময় কাটানো এগুলো অনেকটাই আমার বাবার অভাব মিটিয়ে দেয়। আর সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ....তুমি আমাকে কোনো দিন বলনি মা.....আমি ছোট বলে। কিন্তু, বিশ্বাস কর মা, আমি আর ছোট নেই। এই সমাজ আমায় অনেক বড় করে দিয়েছে। আমি এখন সব বুঝতে পারি। আমি বুঝি মা, বিমানকাকু আমাদের বাড়িতে আসে বলে সমাজের তথাকথিত সভ্য, ভদ্র চেহারাগুলো তাদের হিংস্র নখদাঁত লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। না, মা, কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি বিমানকাকুকে হারাতে চাই না। বরং আমি আমার জীবনে বাবার অভাবটা চিরকালের জন্য পূরণ করতে চাই। মাগো, কখনও আমি তোমার কাছে কিচ্ছুটি চাইনি। আমার লক্ষ্মী মা , আজ আমার এই ইচ্ছেটা পূরণ কর। মাগো, বিমানকাকুকে আমি বাবা হিসেবে পেতে চাই। "


           সব হারানো দুটি নিঃসঙ্গ মানুষ বারো বছরের একটা ছোট্ট মেয়ের মুখে নিজেদের মনের অব্যক্ত ইচ্ছেকে ভাষায় প্রকাশিত হতে দেখে  স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ খানিক পর সম্বিত ফিরে পেয়ে সুরমা মেয়েকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে সশব্দে। যেন মনের বহু বছরের  জমা অপমান, বেদনা সব ঐ কান্নার মধ্যে দিয়ে ধুয়ে যায়। সুমীও পরম স্নেহে মায়ের মত জড়িয়ে ধরে সুরমাকে। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সে বলে ওঠে, "হ্যাঁ মা, কোন সমাজের কথা ভেবে তুমি তোমার পরম বন্ধুকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ? তোমার আপদেবিপদে এই বন্ধুই তোমার পাশে ছিল, সমাজ নয়।" সুরমা চোখভরা জল নিয়ে মেয়েকে আদর করে বলে, " কবে আমার ছোট্ট মেয়েটা এত বড় হয়ে গেল!" চোখের জল মুছে বিমান এগিয়ে এসে সুমী ও সুরমাকে জড়িয়ে ধরে। আজ এই পূর্ণ পরিবারে আনন্দের ঝর্ণা বইছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post